মাল্টায় ভ্রমণ গাইড
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভূক্ত ভূমধ্যসাগর ঘেরা বিশ্বের অন্যতম উন্নত জীবনযাত্রার এক দ্বীপদেশ মাল্টা। সিসিলি ও উত্তর আফ্রিকার উপকূলের মধ্যবর্তী এই দক্ষিণ ইউরোপীয় অঞ্চলটি বুকে ধারণ করে আছে রোমান, মুরস, ফরাসি ও ব্রিটিশ শাসকদের কিংবদন্তি। জীবনধারণের উপযুক্ত জায়গা হিসেবেও প্রসিদ্ধ দেশ এটি।
দেশটি বেশ কয়েক বছর ধরেই অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য দেশটি তৃতীয় বিশ্ব থেকে প্রচুর জনবল নিচ্ছে। বিশেষ করে করোনা মহামারির পরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মত এখানেও বিভিন্ন সেক্টরে দেখা দিয়েছে কর্মী সংকট। ফলে বাংলাদেশের জন্য খুলে গেছে এক অপার সম্ভাবনা দ্বার।
বাংলাদেশিদের জন্য আরও সুখবর হচ্ছে- গতবছরের সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশের রাজধানীতে অস্থায়ী ভাবে চালু হয়েছে মাল্টা কনসুলেট। এর অর্থ- মাল্টার ভিসার জন্য আগের মতো আর ভারতমুখী হতে হবে না।
মাল্টা ওয়ার্ক পারমিট ভিসা নিয়ে বিস্তারিত
দেশটিতে বাংলাদেশিদের জন্য চাকরি ভিসার ব্যবস্থা শুরু হয়েছে ২০১৪ সাল থেকে। বাংলাদেশে মাল্টার কোনো হাইকমিশন না থাকায় বাংলাদেশিদেরকে ভারতের ভিএফএস(ভিসা ফ্যাসিলিটেশন সার্ভিস) গ্লোবালের শরণাপন্ন হতে হতো ভিসা পাওয়ার জন্য। সেখানে আবেদনসহ ভিসা প্রসেসিং ফি বাবদ প্রায় আড়াই লাখ টাকার মতো খরচ হতো। এটি তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যারা নিজেরাই আবেদন করেন। আর যারা বিভিন্ন এজেন্সির সহায়তা নেন তাদের গুণতে হতো প্রায় আট থেকে ১০ লাখ টাকা।
ভিসার আবেদনটি আবেদনকারির নিয়োগকর্তা বা প্রত্যাশিত নিয়োগকর্তা দ্বারা অনুমোদিত হতে হয়। ন্যূনতম ১৮ বছর ও সর্বোচ্চ ৪৫ বছরের মধ্যে এই জব ভিসার জন্য আবেদন করা যায়। এই ওয়ার্ক পারমিট একবার ইস্যু হলে, ভিসাধারী শুধুমাত্র একজন নির্দিষ্ট নিয়োগকর্তার অধীনেই কাজ করতে পারেন। একই লাইসেন্স ব্যবহার করে তিনি অন্য কোনো নিয়োগকর্তার সঙ্গে বা একাধিক কাজ করতে পারেন না।
এই কর্মসংস্থান লাইসেন্সগুলো প্রতি বছর নবায়ন করতে হয়। এই ভিসার জন্য নির্দিষ্ট কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা বাধ্যতামূলক নয়। আর মাল্টায় কাজের জন্য তাদের স্থানীয় মাল্টীয় ভাষা জানতে হয় না; ইংরেজি দিয়েই কাজ চালানো যায়। ঢাকায় ভিসা কনসুলেট চালু হওয়ায় মাল্টাগামী জনসাধারণের আর দালালদের খপ্পরে পড়ে লাখ লাখ টাকা খোয়াতে হবে না।
যেভাবে মাল্টা ওয়ার্ক পারমিট ভিসার জন্য আবেদন করবেন
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
→ আবেদনকারী স্বাক্ষরসহ যথাযথভাবে পূরণকৃত আবেদনপত্র
→ সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডে সদ্য তোলা ৬ কপি রঙিন ছবি (৩৫ মিলিমিটার/৪৫ মিলিমিটার)।
→ মাল্টায় থাকার পর থেকে শুরু করে ন্যূনতম তিন মাস অতিরিক্ত সময়ের জন্য পাসপোর্টের মেয়াদ থাকতে হবে। পাসপোর্টের কমপক্ষে তিনটি ফাঁকা পৃষ্ঠা প্রয়োজন। মুলত পুরো পাসপোর্টই আসল ও অনুলিপিসহ দিতে হবে। পুরানো পাসপোর্ট থাকলে সেটিও সরবরাহ করতে হবে।
→ বিদেশী ভ্রমণের জন্য চিকিৎসা বীমা। বীমা যেন আবেদনকারীর ন্যূনতম ৩০ হাজার ইউরো বা তার সমতুল্য সমস্ত ঝুঁকির (দুর্ঘটনা, অসুস্থতা, জরুরী চিকিৎসা, স্থানান্তর ইত্যাদি) কভার করতে পারে। এখানে বীমার বৈধতার সময়কাল স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে এবং তা যেন মাল্টায় ভ্রমণের তারিখ থেকে কমপক্ষে ৯১ দিন কভার করতে পারে।
→ নিয়োগকর্তার কাছ থেকে আমন্ত্রণপত্র/কভারিং লেটার, যেখানে আবেদনকারীর পেশাগত অবস্থা এবং মালটায় কি কাজ করা হবে তার কাজের বিবরণ থাকবে। আমন্ত্রণপত্রটিতে অবশ্যই অনুমোদিত ব্যক্তির স্বাক্ষর, নাম এবং পদবি উল্লেখ থাকতে হবে। স্বাক্ষরিত কর্মসংস্থান চুক্তিটির ম্যাল্টিজ নোটারি পাবলিক দ্বারা প্রত্যয়িত কপি লাগবে। পাশাপাশি নিয়োগকর্তা কর্তৃক ইস্যুকৃত একটি ডিকলারেশন লেটার সংযুক্ত করতে হবে।
→ আইডেন্টিটি পত্র। এটি আবেদনকারি যে ওয়ার্ক পারমিটের জন্য অনুরোধ করেছেন তার স্বীকারক্তি। এখানে আবেদনকারির দক্ষতা/যোগ্যতা; মুক্ত পেশাজীবীদের জন্য বোর্ড সদস্যতার প্রমাণ; অথবা ডাক্তারদের ক্ষেত্রে মেডিকেল প্রতিষ্ঠানের চিঠি ফটোকপিসহ আসল কপি জমা দিতে হবে।
→ বাসস্থানের প্রমাণ। হোটেল বুকিং/স্বাক্ষরিত ইজারা চুক্তি/প্রমাণের ঘোষণাপত্র যে কোন একটির স্বাক্ষরিত কপি এবং হোস্ট/মালিকের আইডি কার্ডের ফটোকপি। সঙ্গে ম্যাল্টিজ পাবলিক নোটারি দ্বারা প্রত্যয়িত কপি লাগবে।
→ ইউরো পাস ফরমেটে আবেদনকারির স্বাক্ষরিত সিভি, যেখানে রেফারেন্সসহ কমপক্ষে তিন বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
→ পিসিসি(পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সনদ)। এটি আবেদনকারি দেশের কোনো অপরাধ না করে বৈধভাবে মাল্টা যাচ্ছেন তার প্রমাণপত্র।
অনলাইনে আবেদনের উপায়
সকল নথি ক্রমানুসারে প্রস্তুত হয়ে গেলে ভিএফএস গ্লোবালের ওয়েবসাইট থেকে ভিসার আবেদন ফর্ম ডাউনলোড করতে হবে। এই ফর্মটি সঠিক তথ্য দিয়ে ভালোভাবে পুরণ করে সহায়ক কাগজপত্রগুলো একসঙ্গে করে একটি ফাইল প্রস্তুত করতে হবে। এই ফাইলটি ভিসা কনসুলেটে জমা দিলেই আবেদন সম্পন্ন হবে।
আবেদনকারিদের আবেদনের পর ইমেল ও ফোনের মাধ্যমে একটি ট্র্যাকিং কোড পাঠানো হয়। এই ট্র্যাকিং কোড দিয়ে ভিসার সর্বশেষ স্ট্যাটাস জানা যায়। এর জন্য আবেদনকারির শেষ নামসহ ভিসা আবেদন কেন্দ্র দ্বারা সরবরাহকৃত চালান/রশিদে উপস্থিত রেফারেন্স নাম্বার ব্যবহার করতে হবে।
ভিসা প্রসেসিং ফি
একটি একক ওয়ার্ক পারমিটের আবেদনের জন্য খরচ ২৮০ দশমিক ৫০ ইউরো বা প্রায় ২৮ হাজার ২০৬ বাংলাদেশি টাকা, যেটি আবেদন জমা দেয়ার মুহূর্তে দিতে হয়। যে কোনো ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড দিয়ে অনলাইনে এই টাকা জমা দেয়া যাবে। এছাড়া ব্যাংকে গিয়েও টাকা জমা দেয়া যাবে। ব্যাংক থেকে একটি জমা রশিদ সরবরাহ করা হবে। সেটি আবেদনপত্রের সঙ্গে দেয়ার জন্য সংরক্ষণ করতে হবে।
মাল্টা ওয়ার্ক পারমিট ভিসার আবেদনপত্র যেখানে
প্রয়োজনীয় সকল সংযুক্তিগুলো সব একসঙ্গে করে আবেদন ফর্মের সঙ্গে এক ফাইলে জমা করতে হবে। তারপর চলে যেতে হবে ঢাকার মাল্টা কনসুলেট অফিসে। তারা আবেদনপ্রাপ্তি স্বীকার করে একটি টোকেন দিবে, যেখানে ভিসা প্রদানের তারিখ উল্লেখ থাকবে। এই টোকেন দেখিয়ে নির্দিষ্ট দিনে পাসপোর্ট-ভিসা সংগ্রহ করা যাবে।
মাল্টা ওয়ার্ক পারমিট ভিসা পেতে কতদিন সময় লাগে
ওয়ার্ক পারমিট ভিসার জন্য প্রক্রিয়াকরণের সময় তিন থেকে সাড়ে তিন মাস। এটি অনেক সময় চার মাস পর্যন্ত হতে পারে। সব কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে পাসপোর্টে একটি স্টিকার ভিসা যুক্ত করে দেয়া হয়। এটিই মালটার ভিসা; মূলত মাল্টার কোনো ই-ভিসা ইস্যু হয় না। ভিসা সংগ্রহের জন্য আবেদনকারিকে নিজেকেই উপস্থিত হতে হবে।
যদি কোনো কারণে নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত না হওয়ার আশঙ্কা থাকলে তার পক্ষ থেকে মনোনীত প্রতিনিধিকে পাওয়ার অব এটর্নি দিতে হবে। অতঃপর সেই মনোনীত প্রতিনিধি তার হয়ে তার ভিসা সংগ্রহ করতে পারবেন। চূড়ান্তভাবে মালটার মাটিতে পা রাখতে রাখতে সর্বমোট ছয় থেকে সাত মাস সময় লেগে যেতে পারে।
ভিসার মেয়াদ
মাল্টায় কাজের জন্য অনুমিত এই ভিসার মেয়াদ দুই বছর। সময়টি প্রয়োজনে বাড়িয়ে নেয়া যেতে পারে। তবে এই মেয়াদ বৃদ্ধিটা নির্ভর করবে নিয়োগকারির সাথে কর্মচারির চুক্তির উপর।
এর আগে বাংলাদেশে ভিসা প্রসেসিং-এর ব্যবস্থা না থাকায় বিভিন্ন সমস্যা জনিত কারণে অনেকেরই মাল্টা ওয়ার্ক পারমিট ভিসা আটকে ছিলো। এবার তারা এই ঝামেলা থেকে মুক্তি পাবেন। এর জন্য ভিএফএস সেন্টার থেকে ইমেইলকৃত ট্র্যাকিং নাম্বারটি ব্যবহার করে দিয়ে ভিসা স্ট্যাটাসটির স্ক্রিনশট নিতে হবে। এরপর তার প্রিন্ট কপি নিয়ে তার সঙ্গে ভিসা আবেদনের সময় যে কাগজপত্র দেয়া হয়েছিলো তার এক সেট কপি সঙ্গে নিতে হবে। তারপর ঢাকা কনসুলেট অফিসে গেলেই দেয়া হবে মাল্টার জব ভিসা।
মালটায় প্রতি সপ্তাহে ৪০ ঘন্টা কাজের সুযোগ রয়েছে, যেটা সর্বোচ্চ ৪৮ ঘন্টা পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে। ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ইমারত শ্রমিক হিসেবে প্রায় তিন হাজার বাংলাদেশি বৈধভাবে মাল্টায় যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। সবদিক থেকে মাল্টা সরকারের এই প্রস্তাবটি বাংলাদেশের জনসাধারণের জন্য একদিকে যেমন বেশ লোভনীয়, অন্যদিকে বাংলাদেশের রেমিটেন্স আয়ের জন্যও এক দারুণ সম্ভাবনা।